top of page

বাস্তবতার শিকার যারা 

kids_edited.jpg

হাশেম ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার তৃতীয় দিন খুব সকালে যখন সবাইই প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে আড়মোড়া ভাংছিলো, দমকল বাহিনী তাঁদের হোসপাইপগুলো গুটিয়ে নিচ্ছিলো, তখন সন্তর্পনে এই ১৩ থেকে ১৭ বছরের ছেলেগুলো চুপিচুপি কারখানার বাইরে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।

হেঁটে গিয়ে তাঁদের সাথে যেচে পড়ে কথা বলি। একেকজনের বয়স জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করে বলে ১৮ কিংবা ১৯ কিংবা ২২ বছর। কিন্তু নাকের নিচে ফিনফিনে গোঁফের রেখা বলে অন্য কথা।

একটু চেপে ধরতেইই আসল কথা বেরিয়ে আসে। ভোলার চর ফ্যাশন এলাকার ছেলে তাঁরা। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়ার দুর্ভাগ্য তাঁদের যেন পিছু ছাড়ে না! জলবায়ু পরিবর্তনে নদীভাঙ্গনের শিকার পরিবার তাঁদের কষ্টময় জীবনকে আরও ত্বরাণ্বিত করে।

দালালের হাত ধরে ঘন্টাপ্রতি ২০ টাকা মজুরিতে কাজ করতে ঘর হতে শত মাইল দূরের নারায়ণগঞ্জ আসে তাঁরা। একসাথে অনেকে। একেবারে উপোস থাকার বদলে মেলে তিনবেলা খাবারদাবার। সাথে বাবা-মা'কে আর্থিক সহযোগিতা করার অবকাশ। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির মাঝেও তাঁরা খুঁজে পায় জীবনের মানে।

যেই শৈশব-কৈশোর ছিলো মাঠেঘাটে দুরন্তপনার, তা এসে ঠেকে কারখানার অন্ধকার শ্রমিক কোয়ার্টারের ঘিঞ্জি কক্ষে। তা-ও চলছিলো বেশ! ছিলো না কোনো অভিযোগ।

বৃহঃস্পতিবারের দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায় জটলা বেঁধে ঘর ছেড়ে বের হওয়া এই রুটিরুজি তৈরির মেশিনগুলোর অনেকেই। যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাদের ভোর হবার সাথে সাথেই সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চলে, কারণ শিশুশ্রম আইনত দণ্ডনীয়। প্রমাণ হলে খবর আছে (অন্তত কাগজে কলমে তাইই বলে!)

অনেক চাপাচাপি করেও কথা বের করা গেলো না তাঁদের থেকে। চোখেমুখে অজানা ভয়। শুধু জানতে পারলাম, তাঁদের কন্টেকদার (দালাল) বলেছে চলমান কঠোর লকডাউনের মধ্যেও তাঁদের 'জাহাজে' করে বাড়ি ফেরত দিয়ে আসবে।

এত কিসের তাড়া?

ওদের কাছে নিজের নম্বর বিতরণ করে আসলাম। তাঁদের একজন, সুমন (ছদ্মনাম), আজ সকালে ফোন দিলো। 'বাড়ি পৌঁছেছি স্যার।'

- কিভাবে গেলে?

- 'পোস্তগোলা থেকে বালুর ট্রলারে উইঠা গেছিলাম আমরা সবে।'

শুনে আরেকদফা গা শিউরে উঠলো। এদ্দুর এদ্দুর বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এই ভরা বর্ষায় বালুবোঝাই বাল্কহেডে তুলে দিতে পারলো কোন পাষাণ?

পরক্ষণেই মনে পড়লো ওদের সাথেই ঢাকায় আসা হাসনাইনের কথা যার খালাকে গতকাল ঢাকা মেডিকেল মর্গের সামনে দেখেছিলাম। এগারো বছর বয়সী হাসনাইন লকডাউনের আগে ভোলার এক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তো। মায়ের নাকে টিউমার চিকিৎসার খরচ ওঠে না তাই দালালের হাত ধরে সেও এসে কাজ নেয় সেজান জ্যুসের ফ্যাক্টরিতে।

হাসনাইন আগুনের প্রথম দিন হতেই নিখোঁজ। হয়তো সে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। নয়তো ঢামেক মর্গের ঠাণ্ডা মেঝেতে রাখা ঐ ফায়ার সার্ভিসের সাদা ব্যাগগুলোর মাঝে কুঁকড়ে যাওয়া লাশগুলোর কোনো একটা সে হলেও হতে পারে। কে জানে? সুমন তো সৌভাগ্যবান, সে বাড়ি গেছে।

এরা খরচযোগ্য। সবসময় ছিলো, আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে।

-- স্যাম জাহান, সাংবাদিক, ২০২১

#অসম্পাদিত

© SAM JAHAN | 2025 | DHAKA, BANGLADESH

* All contents in this website are copyrighted materials. Please don't imitate or copy these without prior permission.

bottom of page