মৃত্যু কি এতো সহজ?

মৃত্যু এখন আর আমাকে কাঁদায় না।
কিছুদিন আগে রূপগঞ্জের কারখানায় আগুনের ঘটনার পর একটা লেখা লিখেছিলাম। মৃত্যু কিভাবে আমার জন্য ডালভাত হয়ে গেছে, সেই বিষয়ক লেখা। কথাটা ১০০ ভাগ সত্য। আবেগ ইমোশন এমন ভোঁতা হয়েছে যে বলার মতোন না!
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পরের কিছুদিন খুব খুব বাজে কেটেছিলো, এখনো মনে আছে।
মনে পড়ে যেদিন উহান থেকে ফ্লাইট আসছে সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশিদের নিয়ে, সেই উড়োজাহাজের ছবি তুলতে গিয়েছিলাম অতি নিরুৎসাহের সাথে, গায়ে একশো রকমের সম্ভাব্য নিরাপত্তা পরে। তবুও মন খচখচ করছিলো, গলা খুশখুশ লাগছিলো। সেই যাত্রীদের আগমনের কয়েকঘন্টা আগে তাঁদের কোয়ারেন্টিন আবাসস্থল হাজী ক্যাম্পে ছবি তুলতে গেলাম। সেখানে গিয়েও মনে সন্দেহ, 'করোনা মনে হয় হয়েইই গেলো আজ!'
ভয়টা আমার একার ছিলো না। অস্বস্তিতে ছিলেন সবাই -- অন্যান্য সাংবাদিকেরা, দায়িত্বরত পুলিশ-প্রশাসন, ড্রাইভার... সবাইই! এমনকি তাঁদের হাজী ক্যাম্পে এনে রাখার পর বাইরে দর্শকের ঢল নামে, আমাদের জাতিগত স্বভাবের দোষে। তবে সেই কৌতূহলীরাও ছিলেন প্রচণ্ড সতর্ক।
প্রায় দেড় বছর মনে হয় হতে চললো বাংলাদেশে করোনার উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে। সতেরো হাজারের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে এই অদ্ভূত ব্যাধিতে মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১১ লক্ষ। এর মধ্যেই চলেছে লকডাউন, বিধিনিষেধ ইত্যাদি। নিরুপায় ও কি করবে তা বুঝে উঠতে না পারা কর্তৃপক্ষ নানাবিধ সিদ্ধান্ত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বাচ্চাকাচ্চারা স্কুল-কলেজ কি তা ভুলেইই গিয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিত্যনতুন গবেষণামূলক আইন প্রয়োগে হয়েছে মানুষের হয়রানি।
কিন্তু এসব বিবিধ কার্যকলাপে সবচাইতে বেশি যেটা হয়েছে -- একান্তইই আমার ব্যক্তিগত অভিমত যদিও -- সেটা হচ্ছে গণমানুষের গায়ের চামড়া প্রচণ্ড মোটা হয়ে গেছে। এই হিসেবে, যে, করোনাভাইরাস একেবারে নিজের দোড়গোড়ায় এসে গুঁতো না মারলে, অর্থাৎ, নিজের আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে কেউ এই রোগে মৃত্যুবরণ না করলে আমরা কেউইই মোটামুটি তোয়াক্কা করছি না আর।
হাবাগোবা অর্ধশিক্ষিত আর অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী -- যারা কুসংস্কারের আখড়া ভণ্ড ধর্মীয় নেতাদের কথা ছাড়া নিঃশ্বাসও পারলে ফেলে না-- কে দোষ আর কি দেবো, শিক্ষিত সমাজই আর নিজেদের ধরে রাখতে পারছে না ঘরে। স্বাস্থ্যবিধি... সে আর কতোদিন? এসব কথা এখন বাতাসেইই ভেসে বেড়ায়। মাস্ক পরে পরে মুখের চামড়ায় বলিরেখার মতো দাগ পড়ে গেছে ইতোমধ্যে। হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার মাখতে মাখতে হাতের চামড়া বুঝি প্রতিসপ্তাহেই সাপের মতোন খোলস বদলায়।
এতো সাবধানতা, তবুও মৃত্যু কমে না। চারিদিকের হাহাকার কমে না।
নিজের কথা বলছিলাম; যে মৃত্যু এখন আর আমাকে বিচলিত করে না। গতো দেড় বছরে এই ১৭,০০০ এর অধিক মৃত্যুর প্রতিটির সাথেই যেন আমি তথা সমগ্র সাংবাদিক গোষ্ঠী জড়িত। সরাসরি হয়তো নয়, কিন্তু এই পরিসংখ্যান রাখতে গিয়ে প্রতিদিনই হাতের কড়ি আর ক্যালকুলেটর টিপে কর্মক্ষেত্রের টালি হালনাগাদ করছি আমরা। কি করে বলি যে এই মানুষগুলোর মৃত্যুর সাক্ষী আমরা নই?
যাই হোক, দীর্ঘশ্বাস চেপে বারং বার বাস্তবে ফিরে আসি। আসতে হয়। আজকে কর্তৃপক্ষ আবারও কড়া লকডাউন শিথিল করে দিলেন। বেশ ভালো। গরীব খেয়ে বাঁচুক। কিন্তু দশ কোটি গরীবকে সাতদিন বাঁচাতে গিয়ে পুরো ১৭ কোটি মানুষকে কয়দিনের মৃত্যুফাঁদে ফেলা হলো, সেই হিসাব কে রাখলো, স্বয়ং বিধাতা জানেন!
আজকে লকডাউন খোলার প্রথম সকাল প্রহরে, ভোর ছয়টায়, বেরিয়ে পড়েছিলাম, রিপোর্টিং এর উদ্দেশ্যে। মাওয়া ঘাটে গিয়ে চক্ষু হলো চড়কগাছ! লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়! সবাইই ঢাকা ছাড়ছেন! কেউ গাড়িতে, কেউ বাসে। কেউ পায়ে হেঁটে লঞ্চে উঠে পড়ছেন। কেউবা কিছুর তোয়াক্কা না করেইই উঠে পড়ছেন ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। প্রমত্তা পদ্মার ওপর তখন ভাসছে কালো কালো আষাঢ়ে মেঘ। যেকোনো সময় তুখোড় বৃষ্টি শুরু হবে। তবু লোকগুলো দৌড়চ্ছে। বাড়ি তো যেতে হবে!
তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ হলেও একই সাথে রয়েছেন ব্যাপক শিক্ষিত, সাহেববাবু ধরণের মানুষজনও, যেমনটা একটু আগেই বলছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এতো ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাবার মানে কি? উত্তরটা আমার জানা। তবু যেহেতু রিপোর্ট করতে যাওয়া, তাই জিজ্ঞেস করা। এবং সেই গৎবাঁধা উত্তর, 'আরে ভাই! ইদে বাড়ি যাবো না? বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজনের সাথে ইদ করবো না?'
তীর্যক মন্তব্য আমার মুখ দিয়ে বের হয় না পেশাদারিত্বের খাতিরে। কিন্তু মনে মনে কি কি বলি, তা আমার কাছের মানুষগুলো হয়তো আঁচ করতে পারবেন।
এগিয়ে যাই আরেকটু সামনে। শত শত মানুষ বোঝাই একেকটা ছোট লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে। নৌ-পুলিশের পাঁচজন সদস্য প্রচণ্ড চেষ্টা করছেন ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ও অধিক যাত্রী বোঝাই রোধ করতে। কিন্তু মানুষ যখন লক্ষাধিক আর লঞ্চ যেখানে ডজন ডজন... পাঁচজন মানুষ কিইবা করতে পারেন? তাঁদের চোখমুখ বলছে হাল ছেড়ে দেয়ার কথা। কেবল হয়তো উর্ধ্বতনের আদেশের ভয়েইই 'হৈ হৈ' করে চলেছেন তাঁরা।
ঘরে এসে গোসল করে, হাতের কাজ শেষ করে বসলাম। শুনলাম এলাকার মসজিদের মাইকে শোক সংবাদ। কেউ একজন করোনায় মারা গেছেন। এই ব্যাপারটাও ইদানীং অহরহ হচ্ছে। প্রথম দিকে শিউরে উঠতাম। এখন স্রেফ কানে সয়ে গেছে। অনেক এলাকাতেই ব্যাপারটা এরকমই।
আমাকে কাছের মানুষজন অনেকে বলেন, তুমি এতো কথা বলো, নিজে তো রোজ রোজ বের হও! তাহলে এত জ্ঞান মানুষকে দেয়া কেন?
ভাই রে! বের হতে যে আমার খুব ভালো লাগে, ব্যাপারটা তা নয়। যেহেতু আমার পেশাইই রিপোর্টিং করা, তাই আমাকে বের হতেইই হয়। আপনি আমাকে একটা 'একশোভাগ ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চাকরি দেন। আমি সেই কাজে যোগ দেই। আর বের হবো না, ঘরে বসেইই না হয় কাজ করবো। বের হতে আমার আর ভালো লাগে না। এত নির্লিপ্ততা এই মৃত্যু উপত্যকায়... পুরো ব্যাপারটায় আর মন খারাপ হয় না বরং মেজাজ খিচড়ে যায়।
কারণ মৃত্যু এখন আমাকে আর কাঁদায় না।
-- স্যাম জাহান, সাংবাদিক
#অসম্পাদিত



