top of page

একটি সত্য ভোরের অপেক্ষায়... 

sw1.jpg

তিনি ছিলেন এদেশের রাজকন্যা। 

 

অন্তত তিনি নিজেকে তা-ই মনে করতেন বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। প্রচণ্ড দম্ভের কাছেই যেন পরাজিত হয়ে চলে যেতে হলো তাঁকে। কিন্তু আফসোস, তবু সেই দম্ভে একবিন্দু কমতি রইলো না! 

 

১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর নানাবিধ বাঁধাবিপত্তি পেরিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় এলেন। ইতিহাসবিদ আমি নই। সেই বিশ্লেষণে যাবার প্রয়োজন বোধও করছি না। 

 

২০০৯ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। বিডিআর বিদ্রোহের ভয়ঙ্কর আগ্রাসে প্রাণ হারালেন তুখোড় মেধাবী কিছু সেনাকর্মকর্তা। সে কথা সেনাবাহিনীর বর্তমান উর্ধ্বতনদের সহজে ভুলে যাবার কথা নয়। সেনাকুঞ্জে গিয়ে সেই ক্রোধান্মত্ত কর্মকর্তাদের থিতু করে দিলেন তিনি। চাকরি চলে গেলো আরও একরাশ সেনা কর্মকর্তার। নিজের দম্ভ দিয়ে যেন চাপা দিয়ে দিলেন সেনাবাহিনীর গর্ব। 

 

এরপরে এলো দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচন। পেশীশক্তি কাজে লাগিয়ে, উর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তাদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিঃশব্দ করে রেখে এবং প্রশাসনিক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় নিজেদের ক্যাডার বাহিনীর লোকদের দিয়ে ভরে ফেলে কি করে তিনি পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন হন, তা কারও অজানা নয়।

 

দীর্ঘ ১৫ বছর রাষ্ট্র শাসনের পর যখন আরও একদফা তিনি প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় দ্বাদশ সংসদেও ‘জয়ী’ হলেন। ইতোমধ্যে তাঁর হাজারো প্রটোকল। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্ট এবং একপাল দলীয় ষণ্ডা দিয়ে ঘেরাটোপের এক জীবন ছিলো তাঁর। চারিদিকে কেবল তোষামোদকারী তাঁর। দেশের সকলকিছুর নামে তাঁর পরিবার এবং তিনি নিজে। তাঁরা যে তাঁকে কি বুঝাতো, কে জানে!

 

রাস্তা দিয়ে গেলে মানুষকে শুধু দাঁড় করিয়ে রেখেই ক্ষান্ত হতো না তাঁর নিরাপত্তা দানকারীরা। মানুষজনকে উলটো করে দাঁড়াতে বলা হতো। ‘চাকরি যাবে গিয়ে আমার বাইন*দ, উলটা ঘুর!’ – আমাকে বলা এক মেহেদীরাঙ্গা দাড়িযুক্ত মুরব্বি কনস্টেবলের উক্তি। সেই ২০১৭ সালে। আজও মনে গেঁথে আছে। 

 

চাকরি। একটি অদ্ভুত ব্যাপার! পেটের দায় মেটানোর মধ্যবিত্তীয় উপায়। কাজের বিনিময়ে অর্থ। বিগত দশ-বারো বছরের পেশাদার জীবনে প্রচুর মানুষের সাথে মিশেছি। তাঁদের অনেকের মুখে শুনেছি কি করে চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে পারাটাই জীবনের সার্থকতা। হোক সে কমপয়সার চাকরিওলা সিকিউরিটি গার্ড। কিংবা তোয়ালেযুক্ত চেয়ারে, এসিরুমে বসা ফুলবাবু। আবার এই যে হালের আন্দোলন। সে-ও কিন্তু এই চাকরি ঘিরেইই। 

 

সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন গত ১৫ বছরে বেড়েছে বহুগুণ। সুযোগসুবিধা, বিলেত ভ্রমণ, নানাবিধ প্রশিক্ষণ… কি নেই! কিন্তু সেসব ছিলো কেবল তাঁদের জন্যেই, যারা তোষামোদ করে টিকে থাকতে পেরেছে। বহু পয়সা খরচ করে সরকারি চাকরি খোঁজা মানুষগুলোর মনোভাব বুঝতে আমার বহু দেরি হয়েছে। ‘ও! তাহলে সরকারি চাকরি চাইলেই চলে যায় না! আবার অবসরপরবর্তী ভাতা মেলে!’ বাহ! এজন্যেই তবে জায়গাজমি বিক্রিবাট্টা করে অজপাড়াগায়ের ঐ ছেলেটা আজ ঘুষ দিয়ে সুপারিশ করে অফিসার! আবার সেই খরচ ওঠাতেই তবে সে… আশ্চর্য দুষ্টচক্র! কি সাদাসিধে বোকার হদ্দ আমি! এ সহজ সমীকরণ বুঝতে ত্রিশ বসন্ত পার!

 

আমাদের রাজকন্যার কথায় ফিরি। 

এই যে চারিদিকের দুষ্টচক্রগুলোর যোগফল যে কতবড় রাষ্ট্রীয় ক্ষতি, তা তিনি চোখ থাকিতে অন্ধের মতন হয় এড়িয়ে গেছেন নয়তো দেখেনই নি। অবশ্য কি করে বিশ্বাস করি যে তিনি দেখেন নি? বিভিন্ন প্রেস ব্রিফিংগুলোতে দেখেছি দশমিক পৌণপুনিক এর হিসাবও প্রায় তাঁর ঠোটস্থ। অর্থাৎ তিনি চুপ থেকে গিলে গেছেন সকল দুর্নীতি-দুর্দশা। 

 

কথায় কথায় তিনি সামরিক বাহিনীকে অপদস্থ, অপমান করতেন। কারণ একটাই। তাঁর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পেছনে এই উর্দিপরিহিতরাই যে ছিলেন! স্বজনহারানোর বেদনা সংক্রান্ত যে ভাঙ্গা টেপ আমরা শুনতে শুনতে ক্লান্ত, সেটা যে আসলেই তাঁর জীবনের সবচাইতে বড় ট্রমা এবং একমাত্র দুঃস্বপ্ন, এটা বোঝার বাকি ছিলো না কারও। যে যা-ই বলুক, যেই থিওরিই হাজির করুক। পিলখানা ট্রাজেডি তাঁর একটি বদলা বলেই কেবল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। 

 

তবে কেন সামরিকেরা তাঁর বিরুদ্ধে আরও আগে অবস্থান নেন নি? ঐ যে! চাকরি! তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হতেই বুঝি সাহস পান নি। কিংবা পেলেও তাঁদের ব্যাটেবলে যেন ঠিক মিলছিলো না। 

 

রাজকন্যার ঘৃণা অবশ্য কেবল উর্দিপরিহিতদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো বলে আমার মনে হয় না। যে জাতিকে উদ্ধার করতে গিয়ে তাঁর পিতা বারংবার কারাবরণ করেছেন, পরিবার থেকে দূরে দূরে থেকেছেন, সেই জাতিই যে তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করবেন, সেটা রাজকন্যার অবচেতন মনও যেন বিশ্বাস করতে চায় নি। তবু তা ঘটেছে। সেই ঘৃণা তাই কেবলই পাকাপোক্ত হয়েছে। সেজন্যেই লাশের পর লাশ পড়ে গেছে, তিনি দমতে চান নি। তাঁর আকাঙ্ক্ষা – তাঁকে রাজকন্যার পদ থেকে কেউ নামাতে পারে না। এই পদটা তাঁর জন্মগতভাবে প্রাপ্য। 

 

সাম্প্রতিক যে তরুণ-যুবাদের আন্দোলন, তা যৌক্তিকভাবে সমাধান করা যেতো খুব সহজেই। আন্দোলনকারীদের আদর করে কাছে ডেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে দ্বিতীয় সপ্তাহেই শেষ হয়ে যেতো সব ক্ষোভ-আক্রোশের। কিন্তু হায়! আমাদের রাজকন্যা যে বড্ড দাম্ভিক! 

 

তাঁর তোষামোদকারীরা তাঁকে কি বোঝালো, কে জানে! তিনি বয়সের ভারে কিংবা দাম্ভিকতার সর্বশেষ সীমানায় পৌঁছে তাঁদের ডেকে বসলেন চরম একটি বাজে উপাধি দিয়ে। এমন এক মানুষ, যে কিনা পরিণত হয়েছিলেন দেশের প্রতিটা সমস্যার শেষ আশ্রয়ে, তাঁর কাছ থেকে এহেন মন্তব্য সইতে পারলো না তরুণেরা। নেমে এলো ঢল দেশ জুড়ে। আবারও সমস্যা সমাধান করতে না চেয়ে নামিয়ে দিলেন তাঁর পোষ্য বাহিনীকে। শহীদ হলেন আবু সাঈদ। মুগ্ধ। এমনকি ছোট্ট রিয়া। 

 

ছয়টি লাশের পরে দানবিকতা যেন জেঁকে বসলো রাজকন্যা ও তাঁর দোসরদের মগজে। লাঠি হাতে লক্ষ যুবক-যুবতীর দিকে তাক করে নির্বিচারে তিনি অটোমেটীক রাইফেল চালাবার অনুমতি দিলেন। লাশের সংখ্যা শতের ঘর পেরিয়ে গেলো নিমিষেই। 

 

স্বাভাবিকভাবে, সন্তান হত্যার বিচারে মাঠে নেমে এলো বাবামায়েরা। নেমে এলো ভাইবোনেরা। নির্দোষ, নির্ভেজাল কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নিলো একদফায়। রাজকন্যার পতন চাই। আরও গুলি হলো। আরও লাশ পড়লো। রাজকন্যার ১৫ বছরের শাসনের অন্যতম তরিকা - গুম - মেনে হারিয়ে গেলো বহু তরুণ যুবক। জনঢল এবার ফুঁসে উঠলো ঘুমন্ত ড্রাগনের মতন। 

 

ইতোমধ্যে সেই ছাত্রজনতার ভীড়ে মিশে গেলো রাজনৈতিক সর্বহারার দল। পনেরো বছরের বঞ্ছনা কিংবা নিছক রাজকন্যার দলের প্রাচীন ইতিহাসের প্রতি ঘৃণা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো তারাও। মিলেমিশে একাকার হয়ে সবাই যাত্রা করলো রাজপ্রাসাদ - গণভবন - এর উদ্দেশ্যে। একটাই লক্ষ্য। গদি থেকে রাজকন্যাকে নামতে হবে।

 

সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে রাস্তায়। কোথাকার কোন চাপে কিংবা হয়তো নিছক বিবেকের দংশনে তাঁরা সরে দাড়ালেন। এরমধ্যে সময়ক্ষেপণ করে রাজকন্যাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দেশত্যাগ করিয়ে দিলেন তাঁরা। গণভবন গণমানুষের হয়ে গেলো। কিন্তু হায়! বাঙালি এ কি দেখালো! সমানে চললো লুটতরাজ। কেউ বলেছে, ‘দুর্বৃত্তের দল নিজেরা আগেভাগে লুটপাট করে তা ঢেকে দিতেই বুঝি এংরি মবকে ভেতরে যেতে এলাউ করেছে।’ সংসদ ভবনও রক্ষা পেল না লুটেরাদের হাত থেকে। 

 

আগস্টের ৫ তারিখ, ২০২৪ ইং। রচিত হলো এক নতুন ইতিহাস। 

 

স্বৈরাচারী রাজকন্যা উড়ে চলে গেলেন ঠিকই। কিন্তু দম্ভ তাঁর পিছু ছাড়লো না। তাঁর পুত্র সমস্ত বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে গালিই দিয়ে বসলেন। তবে ইট ইস ওকে। বাংলাদেশিদের দায়িত্ব আপনাদের নিতে কেউ বলে নি। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে গার্ডিয়ান সাজতে আসবেন না। 

 

রাতভর চললো তাণ্ডব। ছাত্র আন্দোলন করে যে স্বৈরাচার হঠানো হলো, তা পরিণত হলো যেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পূরণের এক মচ্ছবে। পনেরো বছরে জিইয়ে রাখা ক্ষোভ নিয়ে রাজকন্যার বিরোধীদলীয় মানুষগুলোর রক্তে যেন জিঘাংসা জেগে উঠলো। দুঃখজনক হলেও সত্য তাঁদের সাথে যোগদান করলো ভীষণরকম ডানপন্থী ইসলামী মানুষগুলোও। থানায় থানায় আক্রমণ, প্রতিপক্ষের ঘরে ঘরে আক্রমণ, আগুন, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও পুড়িয়ে ছারখার করে লুটপাট করা হলো। 

 

পুড়িয়ে নাশ করে ফেলা হলো ধানমণ্ডি ৩২ এর জাদুঘর, যা কিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের নিশ্ছিদ্র একটি অংশ। সামরিক বাহিনী ভোর পর্যন্ত কারফিউ জারি করে রেখে নিজেরা যে কই গিয়ে বসে রইলেন, তারাইই জানেন! 

 

আগস্টের ৬ তারিখ। সারা দেশে কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেখা মিললো না। সবাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আগে ছাত্ররা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে গেলো রাস্তায়। আগের দিনের স্বৈরাচার পতনের বিজয় মিছিলের চিহ্ন হিসেবে পরে থাকা আবর্জনাও পরিষ্কার করে দিলেন তাঁরা। 

 

কিন্তু এদিকে শুনতে থাকলাম ক্ষমতাবঞ্চিত একটি দলের এক নির্বাসিত ও বিতর্কিত রাজপুত্রকে নিয়ে ফিসফাস। তিনি নাকি দেশে এসে দেশ বদলের নায়ক হবেন। তাঁর পিতাও এদেশের স্বাধীনতার একজন নায়ক বটে। বিবিধ বিশেষণ সম্বলিত সেই রাজপুত্র যদি হয় আগামী বাংলাদেশের নেতা, তবে আমি সামনে এগুবার খুব একটা আশা দেখছি না। 

 

রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। আমি খুব খুব সামান্য একজন সাংবাদিক; বিশ্লেষক মোটেও নই। আমার একটাই প্রত্যাশা। 

 

শত শত লাশ পড়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তা ও প্রকৃতিমাতার কাছে বিচার চাওয়া এবং অপেক্ষা করা ছাড়া বুঝি আর কিছু করার নেই। কিন্তু এক দাম্ভিকের পাল্লা থেকে এই হতভাগা জাতি যেন আরেক দাম্ভিকের পাল্লায় গিয়ে না পড়ে। ছাত্রজনতার কাছে এটাই একমাত্র চাওয়া। 

 

সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র রেখে যেতে চাই আমার সন্তানের জন্য। 

(অসম্পাদিত)

sw2.jpg

© SAM JAHAN | 2025 | DHAKA, BANGLADESH

* All contents in this website are copyrighted materials. Please don't imitate or copy these without prior permission.

bottom of page